Friday, July 28, 2006

নামহীন (১৫.০৭.০৬)

তোমার আঁচলের ছায়ায় আমি কাটিয়েছি বহুকাল। বাঁচিয়েছি নিজেকে ঝড়-জল-ঝঞ্ঝা থেকে। তোমার চোখের তারায় প্রস্ফুটিত নৈসর্গিক প্রতিচ্ছবি একদৃষ্টে আবেশিত হয়ে উপভোগ করেছি। তোমার কোমল হাতের স্পর্ষে আমি জুড়িয়েছি আমার দেহের সমস্ত উত্তাপ। প্রবল অন্ধকারে জড়িয়ে ধরেছি তোমায়, ভীত সন্ত্রস্ত মনে সাহস আনার প্রচন্ড আশায়। তোমার গায়ের গন্ধ আঘ্রাণ করে আবিভূত আমি উড়ে বেড়িয়েছি হাওয়ায় হাওয়ায়। জোনাকির আলো দিয়ে আঁকা তোমার টিপের চ্ছটায় উদ্ভাসিত মুখ আমি স্মৃতির প্রতিটা অন্ধকুঠুরিতে সযত্নে রক্ষন করেছি। আমার কপালে এঁকে দেওয়া তোমার ঠোঁটের আর্দ্রতা নিয়ে আমি একলাফে পাড়ি জমিয়েছিলাম সাত সমুদ্র তেরো নদী। দ্রুতগামী যানের থেকেও দ্রুততর আমি চলেছি পথ বেয়ে। রাস্তার রুক্ষতায় ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত আমার পা তুমি ধুইয়ে দিয়েছ। স্নেহের স্পর্ষে তুমি ভুলিয়ে দিয়েছ রক্তক্ষরনের জ্বালা। অপ্রতিরোধ্য আমি! আমার গতি হয়েছে দ্রুত থেকে দ্রুততর। যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হৃদয়ের প্রবল প্রেমোচ্ছাসে চেয়েছি তোমার প্রশ্রয়। তোমার মুখের ঔজ্বল্য নিয়ে আমি হৃদয়ের প্রতিটি প্রান্ত সেদিন রাঙিয়েছিলাম। অপ্রতিরোধ্য আমি! আমার গতি হয়েছে দ্রুত থেকে দ্রুততর। এক লহমায় আমি পেড়িয়ে এসেছি কতশত আলোকবর্ষ! আজ আর তোমার মোহিনী রূপ চোখে পড়েনা আমার। জরাক্লিষ্ট জীর্ণ তুমি আজ আমার কাছে। আমার ব্যাথায় উদ্বিগ্ন তোমার যন্ত্রনাক্লিষ্ট মুখ পড়ে থাকে রাস্তার ধুলায়। আমার অবহেলায় তোমার আবেগলাঞ্ছিত চাহনি নিদারুন কাঠিন্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরে গেছে বারংবার। মাতৃপরিচয় আজ পরিবর্তিত আমার। আমার কাছে আজ তুমি ভাষা একটি, শুধুই ভাষা! তবুও তোমার কাছে আমার একটি অনুরোধ আছে। কখনও যদি আবার ভবিষ্যতে ফিরে আসি তোমার কাছে, শুতে চাই তোমার কোলে মাথা রেখে। মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নিওনা আমাকে। ভূলে যেও তোমার জঠরে সিঞ্চিত রস গ্রহন করে তিলে তিলে তৈরী হয়েছিল আমার প্রতিটা কোষ। তোমার গর্ভ থেকেই জন্ম নিয়েছিলাম আমি, এই পৃথিবীতে!

নামহীন (২৯.০৬.০৬)

তীব্রতার তারতম্যে কিছু পার্থক্য ঘটে বইকি! নিশ্চিহ্ন বনস্পতির কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়া শুকনো রক্তের দাগ মাটিতে বুক ঘষে চলা শুঁয়োপোকার বুকে স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রেখে দেয়। অথবা মরুপ্রায় মাটির ফাটল থেকে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস হয়ত মেঘসিক্ত করে শহরের কংক্রিট জঙ্গল। অন্তঃহীন চাহিদার ফলস্বরুপ স্তুপকৃত মৃতদেহ জায়গা নেয় শহীদবেদী থেকে শত মাইল দূরে বানিজ্যিক কোন ঘেরাটোপে। তীব্রতার তারতম্যে কিছু পার্থক্য ঘটে বইকি! বাস্তুহারা সেই নীল পাখিটার স্বপ্ন সবুজ ঘিরে থাকে কোন নামী সংস্থার জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন। শহুরে হওয়ার আপ্রান চেষ্টায় দীর্ঘয়িত হয় তার ছন্দবদ্ধ লয়। অত্যাশ্চরয প্রযুক্তির হাত ধরে তার ঘরের কোনে আজ প্রতিটা মুহুর্ত ভোর, কৃত্রিম! সূর্যোদয় ভ্রমে মাঝরাতে গেয়ে ওঠা তার সুরেলা সঙ্গীত শেষে প্রাপ্তি অশ্লীল শব্দবন্ধ অথবা ধেয়ে আসা পাথরের টুকরো। তার সহবাসী সেই কালো সাপটাও আজ স্থির, নিথর। বহুকাল আগে, এখানেই কোনো বনস্পতির শাখায় তার সন্তানের শেষকৃতঃ হয়েছিল সাপটার ক্ষুধা নিবারনে। তবুও আজ কোনো দূরত্ব নেই তাদের মধ্যে! শীতের আঘ্রাণ নেওয়ার প্রানপণ চেষ্টায় তাদের নাকের গর্ত থেকে ফুসফুসের প্রতিটা কোষে সীসা আর কার্বনের স্থায়ী ছাপ। আরও ভয়ঙ্কর কোনো করালগ্রাসে আজ তাদের আগত সমস্ত সন্তানেরা পঙ্গু বা মৃত। তারা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। কালো ধোঁয়া জর্জরিত আকাশের বুক থেকে খুঁজে পেতে চায় তাদের হারিয়ে যাওয়া তারাগুলোকে। তাদের চোখের তারার প্রতিচ্ছবিতে আকাশ ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে লাল। সূর্যদয় আসন্ন! তাদের স্বপ্নদৃষ্টি বেয়ে শহরের প্রতিটা কংক্রিট আজ সবুজ। তীব্রতার তারতম্যে সত্যিই অনেক পার্থক্য ঘটে!

নামহীন (০৩.১১.০৪)

তোমার হালকা চুলে আমি ভাসিয়ে দিতে পারি সহস্র বছরের বসন্ত হাওয়া। নীল সমুদ্র থেকে রঙ নিয়ে রাঙিয়ে দিতে পারি তোমার সাদা শাড়ীর আঁচল। গাঙচিলের ডানায় ভর করে আমি তোমাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারি কোনোও সুদূর রূপকথার স্বপ্নপুরে। মেঘলা দিনেরা জলীয় শীতল হাওয়ায় আমি শুষে নিতে পারি গ্রীষ্মের সমস্ত দাবদাহ। তোমার হাসির উজ্বলতা দিয়ে আমি রাঙিয়ে দিতে পারি সমস্ত রাতের অন্ধকারকে। তোমার ঠোঁটের রঙ আমি তুলিতে মাখিয়ে এঁকে দিতে পারি দিগন্ত বিস্তৃত রামধনু। বদলিয়ে দিতে পারি মেঘেদের রঙ। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ কষ্টকে আমি এক নিমেষে ফুল বানিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি হাওয়ায়-হাওয়ায়। তোমার নাভির থেকে মধু নিয়ে আমি ছড়িয়ে দিতে পারি পৃথিবীর প্রতিটা ফুলে। পাখিদের দিয়ে গাওয়াতে পারি অন্যরকম গান। তোমার চলার পথের সমস্ত কাঁটাকে আমি করে দিতে পারি নরম গালিচা। গজিয়ে দিতে পারি নরম সবুজ ঘাস সমস্ত মরচে ধরা লোহা-কংক্রিটে। স্বপ্ন মিশিয়ে দিতে পারি সকালের প্রতিটা রোদের কণায়। তোমার জন্য আমি সমস্ত খিদেকে বদলে দিতে পারি অফুরান খাদ্যে। রাঙিয়ে দিতে পারি সমস্ত সাদা-কালো জীবনকে। তোমার হাতের স্পর্ষে আমি প্রাণপ্রতিষ্টা করতে পারি সমস্ত প্রস্তর মূর্তিতে। তোমার ত্বকের বিচ্ছুরিত রস্মিতে আমি আটকে রাখতে পারি সূরযাস্তকে, চিরকালের জন্যে। নিসছেদ্র ভালোবাসায় আমি মুড়ে দিতে পারি গোটা পৃথিবীটাকে। তোমার চোখের তারা দিয়ে আমি ভিজিয়ে দিতে পারি সব চিরহরিৎ বনকে। আগাছার জঙ্গলকে বানাতে পারি ফুলের চাদর। তোমার কটাক্ষ দিয়ে বানাতে পারি বিচ্ছুরিত হিরে, প্রতিটা জলবিন্দুকে। তোমার খুশীতে প্লাবিত করতে পারি সকলের মন। আমার হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনে ঘোষনা করতে পারি তোমার আগমনী সুর। তোমার সামান্য ব্যকুলতায় আমি পাড়ি দিতে পারি লক্ষ-কোটি যোজন দূরত্ব। অথচ, আমি এসব কিছুই লিখিনি তোমায়। কারন, এসব আমি কিছুই করতে পারব না তোমার জন্য। কোনো কিছুই না!

নামহীন (০২.১১.০৪)

কষ্টকর কিছু নিদারুন স্বপ্নের হাতছানিতে আমি পাড়ি জমিয়েছিলাম সীমাহীন মহাসমুদ্রে। সিন্দবাদের মতো সামুদ্রিক ঝঞ্ঝা পেড়িয়ে, কোনও কাঠের পাটাতনে ভর করে নিস্তেজ হয়ে পৌঁছেছিলাম এক মরুদ্বীপে। সেই পীলাভ মাটির বুকে বাড়িয়ে তুলতে চেয়েছিলাম একখন্ড সবুজ। ইশদ উন্মোচিত অর্গল দিয়ে ঢুকে পড়া হাওয়া এলোমেলো করে উলটে দিয়েছিল আমার নিষিদ্ধ পান্ডুলিপি। স্থির তড়িৎএর হঠাৎ সংস্পর্ষে আমি ছিটকে গিয়েছিলাম কালো থেকে আরো কালোয়। নিষিদ্ধ কোনও ক্রুদ্ধ অভিশাপে আমি হয়েছিলাম প্রস্তরিভূত। আবার বেড়ে উঠেছিলাম পাঁকের মধ্যে কোনও শালুকের বুক চিরে। ভ্রমরের পাখায় পাখায় উড়ে বেড়িয়েছিলাম এই ফুল থেকে ওই ফুলে। নিভন্ত আগুনের মৃদুমন্দ ধোঁয়ার রূপরেখাকে আমি চেয়েছিলাম কালপুরুষের সূদীর্ঘ ছায়ায় মিশিয়ে দিতে। নীলাভ চাঁদটার বুকে ধারালো ছুরি দিয়ে গভীর রক্তাক্ত ক্ষত করে লিখতে চেয়েছিলাম তোমার নাম, পারিনি! কি করে পারব? এমনিতেই ঐ চাঁদটার বুকে কোনও হৃদয়হীনের দেওয়া ক্ষতচিহ্নগুলো এখনো স্পষ্ট! হাত বেয়ে নেমে আসে অসংলগ্ন শব্দগুচ্ছো। অর্থহীন, বর্ণহীন, গন্ধহীন কিছু কুৎসিত কদাকার ক্ষুধার্ত অক্ষরসমষ্টি। এগুলোকেই তো লোকে প্রলাপ বলে তাই না? মনের মধ্যে আকুলি বিকুলি করা অজস্র শব্দগুচ্ছো নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে অবাধ্য প্রক্ষেপিত হয়। তা আমি চাই বা না চাই। অসংযত শাসনে মন সাড়া দেয় না। বিষাক্ত উদ্গার শেষে নিস্তেজ হয়ে পড়ি আমি। ধীর প্রবাহপমানা কোনও নদীর পাদদেশে আমি তলানি পলি আঁকড়িয়ে ধরি, ছড়িয়ে যাই মাটিতে। সাপের মতো পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠা জংলা লতাগুলোকে দিই প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়। অবশেষে ফুল ধরে সেই অযত্নে লালিত জংলি লতাগুলোয়। অজস্র রঙিন বাহারী ফুল। তাদের তীব্র গন্ধ আমার শরীরে মাদকতা ছড়িয়ে দেয়। মাদকতার তো কোনও প্রকারভেদ হয়না! তোমার আকাশী ওড়নার মৃদুমন্দ মাদকতাই বল বা ঐ নীলাভ অর্কিডটার তীব্র মাদকতা, তফাৎ তো কিছু নেই! সব মাদকতাই তো বুকে ক্ষত সৃষ্টি করে। কিছু লোক আছে যারা আজীবন ক্ষত নিয়ে বাঁচে। আর হয়তো সত্যিই, কিছু লোক আছে যারা বুকে ক্ষত রেখে যায়। চাঁদে ক্ষত রেখে যায়!

নামহীন (০১.১১.০৪)

নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসে কিছু কল্পনা, মেঘপাখির ডানায় ভর করে। পুঞ্জিভূত শূন্যতার কালোমেঘ চিরে ঝলসে ওঠে সমস্ত আলোকে নিভিয়ে দেওয়া তরিৎশিখা। অসহ্য বজ্রশব্দ ছুঁয়ে যায় আমার হৃদয়ের প্রতিটি কোলাহলকে। নিথরতার তবু কিছু মানে থাকে! বুকের ভিতরের মৌচাকের প্রতিটা রন্ধ্র থেকে গলে পড়া প্রতিটা শুস্ক মোমবিন্দু অবয়বহীন কালো ছায়ার রূপরেখা ধরে পালাতে চায়। এক পৃথিবী মরুঝড় শ্বাসরোধ করে আমার। মুখগহ্বর, শ্বাসনালী বেয়ে বয়ে চলে শুস্ক হাওয়ায় ওড়া বালির পাহাড়। আমার ফুসফুসের প্রতিটা কোষে আর ঠোঁটে ধূসর বালি। হয়ত অসাবধানতাবশতঃ রয়ে গিয়েছিল কিছু সাদাকালো স্মৃতির অগোছাল জীবাস্ম। অশরিরী সেই প্রানহীন খড়কুটো জড়ো হয়ে ছুঁতে চায় আমার প্রতিটা অসংলগ্ন পদক্ষেপ। জানি কোনদিনই আমি ছাড়পত্র পাব না এই সব অন্তরঙ্গ নিস্তেজতা থেকে। প্রতিরাত্রে প্রহর শেষে গতিহীন মেঘযান আমার মৃত্যুলগ্নের আতিথেয়তা গ্রহন করবে। অসংলগ্ন বহু প্রলাপ আমাকে জড়িয়ে থাকবে প্রতিটা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ছুঁয়ে যাবে আমার মস্তিস্কের প্রতিটা স্নায়ু, শিরা-উপশিরা। মনের প্রতিটা কক্ষের অর্দ্ধন্মোচিত দরজার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাবে হাহাকার ঝড়। অথবা নিস্পেষিত বিষগন্ধ আমার নাশারন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে আমাকে মৃতপ্রায় করে তুলবে। তবু আমি স্বপ্ন দেখি! মাঝ সমুদ্রে প্রবল ঝঞ্ঝার মাঝে প্রাণপনে আঁকড়ে থাকি পালটাকে, এই আশায় যে কখনও হয়তো ঝড়জল শেষে আমার শুস্ক মুখ ছুঁয়ে যাবে মৃদুমন্দ সাগরের নোনা হাওয়া। হয়তো কোনও একদিন প্রবল চেষ্টার পরে ঘুম নেমে আসবে আমার শরীরে। মৃদু পালকের মতো ভেসে যাব স্বপ্নের হাওয়ায়। হয়তো কোনওদিন ভেসে বেড়াব কোনও এক মিষ্টি মেঘের পাশে পাশে, অনুভব করব তোমার শরীরি গন্ধকে। হয়তো কোনওদিন সেই মেঘ বাড়িয়ে দেবে আমার দিকে তার স্নিগ্ধ পেলব হাত। আবার ফিরে পাব প্রাণ আমার এই অশরীরি শরীরে!